দীর্ঘদিন ধরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক দিয়েই চলছে রাজধানীর নামকরা বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব স্কুলগুলো তাদের সুনাম হারাচ্ছে এবং প্রভাব পড়েছে পরিক্ষার ফলাফলে। প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত প্রধান না থাকার কারণে এসব বিদ্যালয়ে প্রশাসনিক অস্থিরতা বাড়ছে, শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং শিক্ষক ও অভিভাবকদের হতাশ করছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (ডিএসএইচই) সূত্রে জানা গেছে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ এবং উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়েই চলছে কার্যক্রম। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাড়ছে। এসব প্রতিষ্ঠান সূত্র জানায়, এসব বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকরা বিভিন্ন বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন। বিদ্যালয়ের প্রশাসনের অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে অনেক ভারপ্রাপ্ত প্রধানের পাশাপাশি অন্যান্য শিক্ষকরা গ্রুপিং, ভর্তি জালিয়াতি, তহবিল আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অপরাধ ও অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। এর মধ্যে কয়েকটি বিদ্যালয়ে পূর্ণাঙ্গ ম্যানেজিং কমিটি না থাকায় সেখানে নিয়মিত প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।
সুনাম হারিয়েছে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় :
মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষক সংকট চলছে। নিয়মিত গভর্নিং বডির অভাবে কয়েক বছর ধরে শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং চলছে বলে সূত্র জানায়। তহবিল আত্মসাতের অভিযোগে শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতিবাদের মুখে একাধিকবার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বদল করা হয়। চলতি বছরের মার্চ মাসে ওই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পান আখলাক আহমেদ নামে এক সিনিয়র শিক্ষক। এর আগে তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলেও শিক্ষকরা প্রতিবাদ ও ক্লাস বর্জন করলে তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
মনিপুর স্কুলের সংকট এখনো কাটেনি :
গত বছর ইনস্টিটিউটের ৩২৬ জন পরীক্ষার্থী মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিল, যা ছিল প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে খারাপ ফলাফল। এ বছরও এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৩ হাজার ৭৫৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৭০ জন শিক্ষার্থী অকৃতকায হয়েছে। প্রায় ১,৩৩৭ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে, যা এই বছর স্কুলের মোট এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ৩৫%। জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের দিক থেকে প্রতিষ্ঠানটি এখন ১৩তম অবস্থানে। অথচ মাত্র চার বছর আগে ২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় এ প্রতিষ্ঠানের পাসের হার ছিল ৯৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০১৩ সালে, মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে সেরা ফলাফল করেছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এমন অবনতি ঘটেছে বলে সূত্র জানায়। ফলাফলে ক্ষোভ প্রকাশ করে এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, শিক্ষকদের দ্বন্দ্বের কারণে এক সময়ের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। আমার ছেলে ভর্তি হওয়ার পর সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে প্রতিষ্ঠানের মান খারাপ হতে থাকে। এখন আর স্কুল পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। আমি আমার ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।”
প্রভাব হারাচ্ছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল :
রাজধানীর আরেকটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান-ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ-ও একজন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের অধীনে চলছে। কেকা রায়চৌধুরী অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হলে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যায়, যা সম্প্রতি আরও গভীর হয়েছে। এছাড়া বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণিতে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়টি হাইকোর্টে পৌঁছায়, এতে ১৬৯ শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল হয়েছে। ভিকারুননিসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত মুরাদ হোসেন সরকারকে শাস্তি না দিয়ে বদলির মতো নামমাত্র ব্যবস্থা নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেক অভিভাবক বলেন, একজন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। ফলে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় স্কুলটি খারাপ ফলাফর করেছে। এ বছর ভিকারুননিসা স্কুলের ২,১৯৫ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল, যার মধ্যে ৯৮.৪৫% পাস করেছে। এই ছাত্রদের মধ্যে ৩৪ জন ফেল করেছে। স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে জিপিএ-৫ অর্জনকারীদের হার ছিল প্রায় ৭০%, যা আগের পারফরম্যান্সের তুলনায় খুব বেশি চিত্তাকর্ষক ছিল না। ২০১৩ সালে স্কুলটি সেরাদের মধ্যে সেরা ছিল। জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যার দিক থেকে প্রতিষ্ঠানটি এখন অষ্টম স্থানে রয়েছে। ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, “এ বছর ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় স্কুলের ফলাফল একটু খারাপ হয়েছে। এ ছাড়া কোভিড-১৯ মহামারির সময় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছিলেন। সব মিলিয়ে ফলাফল একটু খারাপ হয়েছে। এর কারণে আমরা দুঃখবোধ করছি। তবে প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ কোনো কোন্দল নেই। এ নিয়ে আমি আর কথা বলতে চাই না।
আইডিয়াল স্কুল এখন খুব একটা আদর্শ বলে মনে হয় না :
রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজেও অধ্যক্ষ নিয়ে তোলপাড় চলছে। কলেজের একজন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, ফৌজিয়া রাশেদী, এক ছাত্রীকে ধর্ষণে সহায়তা ও প্ররোচনার অভিযোগে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদত্যাগ করেও নিয়মিত অধ্যক্ষ পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। অপর শিক্ষক মিজানুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে তার বিরুদ্ধে ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মিজানুরকে অপসারণ করে মোহাম্মদ এমাম হোসেন নামে আরেক সিনিয়র শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অর্পিত দায়িত্বকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা দুর্নীতি ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের। মতিঝিল আইডিয়াল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান বলেন, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ সত্য নয়। এ ছাড়া বর্তমানে আমি দায়িত্বে নেই, তাই এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না। আইডিয়াল স্কুলের দুই হাজার ৪১১ জন শিক্ষার্থী এ বছর এসএসসি পাস করেছে, আর অকৃতকার্য হয়েছে ১০ জন। মোট পরীক্ষার্থীর প্রায় ৮১% বা ১,৯৫৬ জিপিএ-৫ পেয়েছে।
উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের খ্যাতি শুকিয়ে গেছে :
রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলও চলছে একজন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আ ন ম সামসুল আলম খানকে দিয়ে। তার বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের তহবিল থেকে অবৈধভাবে এক কোটি টাকার বেশি ব্যয়, শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ, আর্থিক অনিয়ম, অনিয়মিতভাবে শিক্ষকদের পদোন্নতি ও ইচ্ছানুসারে দায়িত্ব বণ্টনের অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটি জাল ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) সার্টিফিকেট দিয়ে জালিয়াতিসহ আ ন ম সামসুল আলম খানের একাধিক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এ প্রমাণ পায় মন্ত্রণালয়। তবে অধ্যক্ষ সামসুল আলম খান এখনো বহাল আছেন। এদিকে, প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ফলাফলে। সর্বশেষ এসএসসি ফলাফলে দেখা যায় যে প্রতিষ্ঠানটির পাসের হার ৯৬.৫৬%। এ বছর বিদ্যালয় থেকে ৭৪৩ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়, যার মধ্যে ২৩৫ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এদিকে স্কুল থেকে ২৬ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী ফেল করেছে। বহু বছর ধরে বিদ্যালয়ে নিয়মিত কোনো ম্যানেজিং কমিটি নেই, যা অধ্যক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আ ন ম সামসুল আলম খান বলেন, “ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়, তবে আমি সবার সাথে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করি। আমাদের ম্যানেজিং কমিটি নিয়মিত করার উদ্যোগ চলছে। যদি সেটা করা যায়, তাহলে হয়তো একজন নিয়মিত অধ্যক্ষও আসবেন। এবং, যদি অধ্যক্ষকে একটি প্রতিষ্ঠানে সবাই গ্রহণ না করে, তবে সেই শিক্ষকের কিছুই করার থাকে না।
সংকট নিরসনে কর্তৃপক্ষ তেমন কিছু করতে পারছে না :
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও ডিএইচএসই-এর কর্মকর্তারা বলেছেন, বেসরকারি স্কুলে দ্বন্দ্ব নিরসনে ম্যানেজিং কমিটিগুলোকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে, কারণ সেখানে সরকার সব সময় ব্যবস্থা নিতে পারে না। তাই এসব বিদ্যালয়ে নিয়মিত ম্যানেজিং কমিটি অপরিহার্য হলেও অনেক প্রতিষ্ঠানে তা নেই। এ ছাড়া এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে, যার কারণে এসব বিদ্যালয়ে সমস্যা সমাধান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এগুলো শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব ফেলে। ডিএসএইচই-এর মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ জাফর আলী বলেন, সরকারি স্কুলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ থাকলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ নিয়োগের দায়িত্ব আসলে ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির ওপর। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিশেষ কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগে তা সমাধানের চেষ্টা করি। তা ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি না। আর যদি কোনো প্রতিষ্ঠান আগের চেয়ে খারাপ কাজ করে, আমরা তথ্য সংগ্রহ করে পরামর্শ দিই।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

ঢাকার নামকরা স্কুলগুলো ভারপ্রাপ্ত প্রধানের অধীনে সুনাম হারাচ্ছে
- আপলোড সময় : ১৯-০৫-২০২৪ ০৯:৩১:৪১ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৯-০৫-২০২৪ ১১:৫০:৪৭ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ